পটভূমি
জেন্ডার সংবেদনশীল কর্মস্থল কর্মসূচির অধীনে ইটিআই কাজ করছে এমন একটা ফ্যাক্টরিতে ১২ সদস্যবিশিষ্ট যৌনহয়রানি অভিযোগ গ্রহণকারী কমিটি গঠিত হয় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। কমিটিতে ছয় জন নারী সদস্য ও ছয় জন পুরুষ সদস্য ছিলেন। ফ্যাক্টরিটিতে ১৩৩০ জন শ্রমিক রয়েছেন, যাদের মধ্যে ৪৩৩ জন নারী এবং ৮৯৭ জন পুরুষ। কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য ছিলো এ বিষয়ে হাইকোর্টের দেয়া গাইডলাইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে যৌনহয়রানি প্রতিরোধের ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী পরিষদ (বিএনডাব্লিউএলএ) ২০০৮ সালে সুপ্রিম কোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করে কর্মক্ষেত্রে যৌনহয়রানি বন্ধের দাবীতে আদালতের নির্দেশনা চেয়ে। কোর্ট ২০০৯ সালে রিটের রায়ের সাথে কর্মস্থলে যৌনহয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠনের জন্য গাইডলাইনসহ নির্দেশনা প্রদান করে।
তৈরিপোষাক খাত প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় খাতগুলোর একটি। এখানে নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমবেশি ৬০ শতাংশ। ফ্যাক্টরিগুলোর কর্মপরিবেশ – পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা এবং অন্যান্য কমপ্লায়েন্সের বিবেচনায় – বিভিন্ন সময়ে আলোচনার বিষয় হয়েছে। নারীদের কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় প্রাতিষ্ঠানিক খাত হওয়ায় নারীর প্রতি হয়রানি ও যৌন নিপীড়নের বিষয়টি নিয়ে সবসময়ই ভাবনা ছিলো। যৌনহয়রানি অভিযোগ গ্রহণকারী কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, সেগুলো নিবারণ করা।
উল্লেখিত ফ্যাক্টরিটিতে কমিটি গঠিত হলেও কমিটি সক্রিয় ছিলো না। কমিটির অর্গানোগ্রাম, দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং কার্যপ্রণালী বিষয়ে ফ্যাক্টরির ম্যানেজমেন্ট ও কমিটির সদস্যদের ধারণাগত ঘাটতি ছিলো। ফলে কমিটি সক্রিয় হতে পারেনি এবং শ্রমিকরা কমিটি সম্পর্কে অবগত ছিলেন না বলে তারা তাদের সমস্যা নিয়ে কমিটির কাছে যেতেনও না।
কমিটিতে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী কমিটি (পিসি) থাকায় বিভিন্ন ধরনের সমস্যার ইস্যু পিসিকে জানানো হতো কিন্তু যৌনহয়রানির বিষয়টি তাদেরকে জানানোর ক্ষেত্রে শ্রমিকদের মধ্যে অনীহা ছিলো। যেহেতু পিসির কাজের ক্ষেত্রের মধ্যে এ বিষয়টি পড়ে না বলে তাদের মধ্যে একটি ধারণা ছিলো। এজন্যে কোনো শ্রমিক এধরনের সমস্যার সম্মুখীন হলে আবেগিক ও মানসিক ক্ষতির শিকার হয়ে সমস্যা সয়ে যেতেন অথবা অন্যকোথাও কাজ খুঁজতেন।
আমরা যা করেছি
ইটিআই বাংলাদেশ ফ্যাক্টরির যৌনহয়রানির প্রতিরোধ কমিটির সাথে কাজ করতে শুরু করে ২০২১ সালের নভেম্বর মাস থেকে। উদ্দেশ্য ছিলো কমিটিকে সক্রিয় করা, তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং যৌনহয়রানি বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি।
” যদি কোনো হয়রানির ঘটনার শিকার হই’ -- এই ভয়ে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে আমি কিছুটা অনিরাপদ বোধ করতাম। আমি ভাবতাম, হয়রানির শিকার হলে আমি হয়তো কাজ চালিয়ে যেতে পারবো না অথবা হয়তো আমাকে হয়রানি সহ্য করে যেতে হবে। কিন্তু এখন আমি একটি নিরাপদ কর্মপরিবেশ পেয়েছি এবং নিজেকে সুরক্ষিত মনে করছি কারণ আমি জানি তেমন কিছু ঘটলে অভিযোগ করার এবং সহায়তা চাওয়ার একটা জায়গা আমার আছে।”
– একজন শ্রমিক বলেছেন
কমিটিকে সক্রিয় করার জন্য, কমিটির দক্ষতাবৃদ্ধির জন্য এবং কমিটির কাজ করার জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ইটিআই যৌনহয়রানি অভিযোগ গ্রহণকারী কমিটির জন্য তাদের দায়িত্ব কর্তব্য এবং কার্যপ্রণালীর উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে, অংশগ্রহণকারী কমিটির জন্য জেন্ডার এবং নেতৃত্ব বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে, ম্যানেজমেন্ট ও সুপারভাইজারদের জন্য জেন্ডার, যৌনহয়রানি এবং জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। এছাড়া ইটিআই কর্মীরা যৌনহয়রানি প্রতিরোধ কটির সদস্যদেরকে নথি সংরক্ষণ, ’নেগোসিয়েশন’, সমস্যা সমাধান বিষয়ে প্রতিনিয়ত পরামর্শ-সহায়তা দিয়েছেন।
ইটিআই ত্রৈমাসিক সভা আয়োজনের মধ্য দিয়ে কমিটিগুলোকে পরস্পরের কাছ থেকে জানার সুযোগ করে দিয়েছে। একই সাথে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন, জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে পক্ষকালব্যপী প্রচারাভিযান উদযাপন ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের নেতৃত্বদানের সুযোগ তৈরি করেছে।
শ্রমিকসহ ফ্যাক্টরির সবাইকে সচেতন করার জন্য যৌনহয়রানি প্রতিরোধ কমিটির ভূমিকা বিষয়ে লিফলেট ও পুস্তিকা প্রকাশ ও বিলি করেছে। জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য গানের অডিও এবং নাটিকার ভিডিও প্রচার করেছে।
ফলাফল
- একটিও হরয়ানির ঘটনা যেনো অগোচরে থেকে না যায় সেজন্য ফ্যাক্টরি প্রাতিষ্ঠানিক কৌশল তৈরি করেছে।
- শুরুতে কমিটি গঠনে হাইকোর্টের নির্দেশণার সবগুলো শর্ত পূরণ করা হয়নি। যেমন কমিটির সভাপতি নারী ছিলেন না। কমিটির কাঠামো ও দায়িত্ব-কর্তব্য নিয়ে ওরিয়েন্টেশন দেয়ার পরে কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে।
- ফ্যাক্টরির সবার মধ্যে যৌনহয়রানি বিষয়ে এবং এবং এ বিষয়ে ফ্যাক্টরির শূন্য-সহিষ্ণুতার নীতি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে এ ধরনের ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনাকে এই কমিটি তাদের লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছে। যৌনহয়রানি বলতে আসলে কোন ধরনের আচরণকে বোঝায় সে সম্পর্কে সবাইকে তারা ওরিয়েন্টেশন দিচ্ছেন।
- যৌনহয়রানির কোন ঘটনা যেনো দৃষ্টির আড়ালে থেকে না যায় সেটা নিশ্চিত কারার জন্য কমিটি নিজস্ব কৌশল তৈরি করেছে যার মধ্যে রয়েছে মাসিক সমীক্ষা।
- প্রকল্প চলাকালীন সময়ে যৌনহয়রানির কোনো ঘটনা কমিটির কাছে কেউ রিপোর্ট করেন নি। কিন্তু কমিটি মনে করেছে যে নারীদের জন্য ফ্যাক্টরিতে কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা থাকা দরকার। এর ফলে তাদের ব্যক্তিগত মানসিক সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করতে পারবেন এবং ফ্যাক্টরির উৎপাদনশীলতায় সেটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কমিটির সদস্যরা শ্রমিকদের এই কাউন্সেলিং-এর কাজটি করছেন।
- দেখা গেছে, কমিটিতে নারী থাকলে নারীরা সেখানে নিজেদের সমস্যাগুলো তুলে ধরতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। যেসব নারীর মধ্যে নেতৃত্বের গুনাগুন আছে তাদেরকে কমিটিতে আনার মাধ্যমে কমিটিতে নারীর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
- কমিটির সদস্যরা ফ্যাক্টরিতে জেন্ডার এ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে কাজ করছেন, ফলে নারীরা যৌনহয়রানির মতো বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করছেন, যেটা আগে ততোটা আলোচনা হতো না।
” আমি কমিটির প্রধান হিসেবে কাজ করতে ভালোবাসি। আমার শ্রমিকদের সাথে আগের চেয়ে ভালো সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। এই কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তাদের জন্য কাজ করাটা আমি চালিয়ে যেতে চাই।”
- যৌনহয়রানি অভিযোগ গ্রহণকারী কমিটির সভাপতি
শিক্ষণ
- ভিডিও ডকুমেন্টারী, গান, ফ্লিপচার্ট এবং বিশেষ দিবস উপলক্ষে প্রচারাভিযানের মতো বিষয়গুলো শ্রমিকরা ভালোভাবে গ্রহণ করেছেন। কারণ এখানে তারা শুধু শ্রোতা নন। বরং কিছু যোগাযোগ কার্যক্রমে তারা যুক্ত পুরো সময় ধরে যুক্ত থাকেন।
- কমিটিতে যে দুজন বহিরাগত সদস্য রয়েছেন, তারা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন; কোনো সুবিধা পান না। তাদেরকে কমিটির মিটিং, ট্রেনিং এ সাধারণত পাওয়া যায় না।
- কমিটির সদস্যদেরকে শ্রমিক হিসেবে তাদের দায়িত্বের অতিরিক্ত কাজ হিসেবে কমিটির দায়িত্ব পালন করতে হয়। এর জন্যে তারা কোনো বাড়তি সুবিধা পান না।
- মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, কমিটির সদস্যসংখ্যা বাড়ালে, বিশেষত নারী সদস্যদের সংখ্যা, ফ্যাক্টরির সবার কাছে পৌঁছাতে সুবিধা হয়। নির্বাচিত সদস্যদের সঠিক দক্ষতার বিষয়টি নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
- হয়রানি সংক্রান্ত কোনো ঘটনা রিপোর্ট করা হয়নি। কিন্ত একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে যে, সুপারভাইজারের কোনো আচরণ নিয়ে শ্রমিকরা রিপোর্ট করতে চান না। তারা ভয় পান যে অভিযোগকারীর নাম জেনে গেলে সুপারভাইজার তাকে আরো সমস্যায় ফেলতে পারেন।